
প্রকাশিত: Sat, Jun 1, 2024 3:42 PM আপডেট: Wed, Apr 30, 2025 12:07 AM
আধুনিক কবিতার সমস্যা
আহসান হাবিব
বাংলা আধুনিক কবিতার বরপুত্র জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন ‘কবিতা সকলের জন্য নয়’। সেই থেকে কবিতার সীমাবদ্ধতার শুরু। কেননা কবিদের জন্য এটা ছিলো এক কুমন্ত্রণা। কেননা সব শিল্পের বেলা এটা সত্য নয়। চিত্রকলার কথাই ধরুন। পৃথিবীর যে কোনো একটি চিত্রকলা-হোক মূর্ত কিংবা বিমূর্ত কিংবা মিথাশ্রয়ী- পৃথিবীর যে কোনো মানুষকে দেখতে দিন, তিনি এই চিত্রকলা দেখে সামান্য হলেও আনন্দ পাবেন। যদিও এই আনন্দের মাত্রার রকমফের থাকতে পারে। পৃথিবীর যে কোনো একটি সংগীত পৃথিবীর যে কোনো মানুষকে শুনতে দিন, তিনি আনন্দ অনুভব করবেন সংগীতের কোনোকিছু না বুঝেই। কিন্তু কবিতা? না, কবিতার রস আস্বাদনের জন্য নাকি বিশেষ প্রস্তুতি লাগবে পাঠকের। কেন? কারণ কবিতা সকলের জন্য নয়। কবিতায় ব্যবহৃত যা কিছু কিংবা তাদের বিন্যাস এমন এক জটিল বুননে প্রস্তুতকৃত যে সেখান রস আস্বাদন করা সকলের জন্য সম্ভব নয়। কারা পারে? পারে গুটিকয় মানুষ, সংখ্যায় খুব অল্প। এরা সমাজের সেই ভাগ্যবান মানুষ যারা এখান থেকে রস অনুভব করার জন্য জীবন প্রণিপাত করেছেন, বিশাল এক প্রস্তুতি নিয়ে নিজেকে তৈরি করেছেন। অথচ একটি গোলাপ ফুলের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আপনি যেই হোন কোনো প্রস্তুতি কিংবা শর্ত ছাড়াই আনন্দ পাবেন। অথচ গোলাপের সজ্জা কবিতার চেয়েও জটিল এবং নিখুঁত। প্রকৃতির যে কোনো বস্তুর দিকে তাকিয়ে আপনি অনির্বচনীয় আনন্দ পাবেন। একজন কৃষক অঙ্কুরিত শস্যের দিকে তাকিয়ে একজন কামার তার নির্মিত বস্তুর দিকে তাকিয়ে অনুপম আনন্দ পান এবং একই আনন্দ পৃথিবীর যে কেউ পান। ব্যতিক্রম কবিতা। কবিতায় কী থাকে?
কবির একটি অনুভব যা তিনি হঠাৎ প্রাপ্ত হয়েছেন যার ভেতরে রয়েছে তার অভিজ্ঞতার সারবত্তা, তিনি তা ম্রূত করেন কবিতার ভাষায়। হতে পারে এই অনুভব নিজস্ব, নতুন, অনাবিষ্কৃত কিন্তু যখন তিনি এটি কবিতার আকারে পাঠকের জন্য ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন তা সকলের জন্য হয়ে উঠছে না, হয়ে উঠছে কতিপয়ের। অথচ তা সকলের জন্য হয়ে ওঠার ইচ্ছা রাখছে। এই ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার কী কারণ, কী থাকে তার নির্মাণ প্রক্রিয়ায়? কবিতা আর কিছু নয়, ভাষার এক নিপুন সজ্জা। ভাষা মানেই যোগাযোগ। তাহলে কবি ভাষার সজ্জায় কিছু একটা বলতে চান। তিনি যা বলতে চান তা কী খুব অবোধ্য কিছু? মনে হয় না। কারণ যখন কবি এরকম একটি কবিতায় কী বলেছেন বুঝিয়ে দেন, তখন তা খুব সহজেই বোধগম্য হয়ে ওঠে, আহামরি কিছু মনে হয় না। তাহলে একটি কবিতা কোনো যাদুবলে বোধের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে? এটা কী কবিতার কোনো বৈশিষ্ট্য নাকি কবির সীমাবদ্ধতা, নাকি এটি আরোপিত? বিজ্ঞান এবং দর্শন যেখানে শেষ হয়, কবিতার সেখানে শুরু যেমন কথা যেখানে শেষ হয়, সংগীত সেখানে শুরু। একটি গোলাপের ফুটে থাকা তার সমূহ গণিতের আয়োজন শেষের পর। তখন একটি গোলাপ যা দেয় তা বিজ্ঞানোত্তর এক আনন্দ। তার রঙ আমাদের চোখে দেয় এক অনির্বচনীয় আনন্দ যা লুকিয়ে রাখে তার সমূহ বিজ্ঞান, তার কম্পনাঙ্কের যাবতীয় গণিত। দর্শন যদি হয় কোনো বস্তুকে বিশেষভাবে দেখা, কবিতা তাহলে দর্শনোত্তর এক নির্মাণ। কেননা আমরা কবিতার ভেতর থেকে পাই দর্শনের অধিক কিছু।
সংগীত কিংবা চিত্রকলা- তার নির্মাণ যতোই কঠিনই হোক তার সংস্পর্শে এলে আমরা এমন এক বোধের ভেতর দিয়ে যাই যা আমাদের চিত্তকে আনন্দিত করে। আমরা এটার আগে যা ছিলাম তা পরে আর থাকি না, বদলে যাই। এই বদল মননের যা পরিশিলীত করে। কিন্তু আধুনিক একটি কবিতা পাঠের পর প্রায়ই আমাদের বোধকে সমাচ্ছন্ন করে না, বরং তা বোধগম্য না হওয়ার কারণে বিরক্তি জাগায়। যথেষ্ট প্রস্তুতি না থাকলে তার ভেতর প্রবেশ অসাধ্য হয়ে ওঠে। কেননা কবিতা ফুলের গন্ধের মতো শুধু অনুভবের বিষয় নয় তা একটি ভাবের যোগাযোগকে কেন্দ্র করে প্রকটিত হয়, তা বোধের অনুকূলে না এলে চিত্তে কিছুই জাগায় না। ফলে সংগীত কিংবা চিত্রকলা যে পথে হাঁটে, কবিতার পথ তার বিপরীতমুখী। পরিণাম কবিতা সকলের জন্য হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু শিল্প ব্যক্তির নির্মাণ হয়েও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠা তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটা শিল্পের দ্বন্দ্ব। এর নিরাকরণ হয় আনন্দ অনুভবের মধ্য দিয়ে। কিন্তু কবিতা নিরাকৃত হতে না পেরে প্রাথমিক দ্বন্দ্বকেই কেবল হাজির করে এবং তা মিমাংসার দিকে এগুতে পারে না। ফলে কবিতা হয়ে পড়ে এক অমিমাংসিত দ্বন্দ্ব। কবিতা হয়ে ওঠার সব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ভাবের গভীরতাকে অক্ষুণ্ন রেখে কেন তার প্রকাশ সারল্যের নান্দনিকতাকে ধারণ করতে অক্ষম? এটা কবিতা নামের শিল্পের সীমাবদ্ধতা নাকি কবির? অথচ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো কতো সহজ কিন্তু কী গভীরতা নিয়ে কালকে জয় করে চলা এক দীপ্যমান প্রদীপ।
বলা হয় যা সহজে বোধগম্য তা পদ্য, কবিতা নয়। কথাটি সত্য মনে হয় না। পদ্য একরকম বোঝা, কবিতা আর এক রকম। পদ্যের সারল্য এবং কবিতার সারল্য এক নয়, কবিতা তার অঅনুভূত জটিল অনুভবের প্রকাশ যখন তা জটিলতার পঙ্কেই আটকে থাকে, তখন সারল্যের নান্দনিকতাকে দোষারোপ করা হয়। শিল্পের লক্ষ্যই হচ্ছে যা কিছু জটিল তাকে সারল্যের সৌন্দর্য দিয়ে নির্মাণ করা। কবিতা, বিশেষত আধুনিক কবিতা সে লক্ষ্য পূরণে অনেকটা ব্যর্থ বলেই মনে হয়। কবিতা যে সকলের জন্য নয়, তাহলে কী এটা শ্রেণী বৈষম্য নির্মাণ করে? হয়তো এটা রাজনৈতিক কোনো বর্গ নয়, এটা একটি সাংস্কৃতিক বর্গ যা গড়ে ওঠে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীন এক বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে। এটা তো ঠিক আধুনিক কবিতা কোনো শ্রমিক বা কৃষকের জন্য নয়, মধ্যবিত্তের খুব কম মানুষের জন্য এটা লিখিত। তাও সব মধ্যবিত্তের জন্য, কবিতাকে আত্মস্থ করার শ্রম স্বীকার করে যারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রস্তুত হয়ে উঠেছে তাদের জন্য। আধুনিক কবিতা যদি সামান্য গুটিকয়েক লোকের জন্য হয়, তাহলে বৈষম্য সৃষ্টকর এই শিল্পের উপযোগিতা কোথায়? কবিতার ভোগ যদি সামাজিক না হয়ে ব্যক্তিক হয় তাও আবার গুটিকয়েকের তাহলে বলাই যায় কবিতা এবং কবি বুর্জোয়াদের চেয়েও সংখ্যালঘিষ্ঠের নগ্ন রাজত্ব কায়েম করতে চায়। তাহলে কী কবিতা পরিতাজ্য? না, কবিতার উপভোগ হোক সামাজিক, কবিতা সেই পথে হাঁটুক যেমন হাঁটে একটি গোলাপ, একটি চিত্রকলা, একটি সংগীত। লেখক: কথাসাহিত্যিক
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
